কক্সবাংলা ডটকম(২৩ ডিসেম্বর) :: দেশে বিদেশি পর্যটক না বাড়লেও গতি এসেছে অভ্যন্তরীণ পর্যটনে। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বাড়ায় মধ্যবিত্তের বিশাল একটি অংশ এখন সাপ্তাহিক ছুটিতে বা এর সঙ্গে বাড়তি এক-দুই দিনের ছুটি পেলেই পরিবার, বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। শুক্র-শনি ও বড়দিন মিলে তিন দিনের টানা ছুটিতে দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে এবারও মানুষের ঢল নামবে। আবার অনেকে দেশের বাইরেও যাচ্ছে।
এতে অভ্যন্তরীণ ও বহির্গামী পর্যটনে প্রাণসঞ্চারের আশা করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে চড়া হোটেলভাড়া, পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা, সেবার মান ভালো না হওয়ায় অনেক পর্যটক বিদেশমুখী হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহির মো. জাবের বলেন, ‘প্যালেসসহ দেশের হোটেলগুলোতে আমি খোঁজ নিয়েছি, এই সপ্তাহে একটি কক্ষও খালি নেই। যে পরিমাণ মানুষ ভ্রমণ করছে, সে পরিমাণ হোটেল-মোটেল আমাদের নেই। এই কারণে ছুটির দিনগুলোতে সমস্যা দেখা যায়। শুধু হোটেল নয়, যাতায়াতের ক্ষেত্রেও বাসে-প্লেনে সিট পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে।
এতে বোঝা যায়, দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটক বাড়ছে। দেশে বছরে দুই কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ করে। এই সংখ্যা এ বছর দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি। ’ তিনি জানান, পর্যটন মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। সেখানে কোন জায়গায় কী পরিমাণ হোটেল দরকার তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র থাকবে।
সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজের চেয়ারম্যান জামিউল আহমেদ বলেন, ‘পর্যটন খাতের দুরবস্থার মধ্যেও অভ্যন্তরীণ পর্যটনের প্রবৃদ্ধি খাতটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু ব্যবস্থাপনার অভাব, নিম্নমানের সেবা ও চড়া মূল্যের কারণে আমাদের পর্যটকদের একটি অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। সেবার মান ও ব্যয়ের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনিটরিং নেই বলে ব্যবসায়ীরা এটা করতে পারছেন। ’
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে দেড় কোটি মানুষ ভ্রমণ করছে। এ বছর সেই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ৩০ লাখের মতো মানুষ প্রতিবছর বিদেশ ভ্রমণ করে, যাদের বেশির ভাগই প্রতিবেশী ভারতে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই ২৯ লাখ ২১ হাজার ৫২০ বাংলাদেশি পর্যটক বিদেশে গেছে। তাদের ৬০ শতাংশের বেশি গেছে ভারতে। এ ছাড়া সৌদি আরব (৮.১২ শতাংশ), মালয়েশিয়া (৪.৫৭ শতাংশ), থাইল্যান্ড, দুবাই, আফ্রিকা, নেপাল ও তুরস্কে গেছে তারা। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩৩ হাজার ৬৮৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৩.০২ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যা ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। পর্যটন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ৪০ লাখ মানুষ।
কোথায় এখন কেমন অবস্থা
কক্সবাজার : কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ২৩ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হোটেল-মোটেলগুলোতে আগাম কক্ষ বুকিংয়ের হিড়িক পড়েছে। গত সোমবার সৈকত ঘুরে দেখা গেছে, সাগরপারের কলাতলী, সুগন্ধা, সি-গাল ও লাবনী পয়েন্টের বালিয়াড়িতে মাঝারি রকমের ভিড় রয়েছে পর্যটকের।
কুয়াকাটা : ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের ছুটি উপলক্ষে কুয়াকাটায় সব হোটেল-মোটেলের প্রায় সব সিট বুকিং হয়ে গেছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে পর্যটকের আগমন বৃদ্ধি পাওয়ায় পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যাবসায়িক বেচা-বিক্রিও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুন্দরবন : সুন্দরবন ভ্রমণের এখন ভরা মৌসুম চলছে। গত শনিবার ২২টি ট্যুরিস্ট লঞ্চ অবস্থান করে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কটকায়, যা গত তিন থেকে চার বছরের মধ্যে সর্বাধিক ছিল।
সুন্দরবন কেন্দ্রীয় ট্যুরিস্ট কম্পানি সূত্র জানিয়েছে, এ বছর পর্যটকের আগমন বেশি। আগামী শুক্র, শনি ও রবিবার তিন দিনের ছুটি উপলক্ষে খুলনা ও মোংলার কোনো লঞ্চেই বুকিং খালি নেই। এমনকি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসও বুকিং হয়ে গেছে। বন বিভাগ জানিয়েছে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে পর্যটকের সংখ্যা।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
করোনা মহামারির প্রভাবে দেশের পর্যটন খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। সাম্প্রতিক জরিপে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, করোনায় পর্যটন খাতে চাকরি হারিয়েছে এক লাখ ৪১ হাজার মানুষ। মোট ক্ষতির মধ্যে পরিবহনে ৪০ শতাংশ, হোটেলে ২৯ শতাংশ এবং রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁয় ক্ষতি ২৫ শতাংশ।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী সম্প্রতি বলেছেন, ‘করোনার এই সময়েও প্রায় দুই কোটি অভ্যন্তরীণ পর্যটক দেশের ভেতরে ভ্রমণ করেছে। দেশের পর্যটনশিল্পের গতি ফিরতে শুরু করেছে। ’
পর্যটন খাতের শীর্ষ সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে, কিন্তু আমরা বিশ্বের কাছে সেভাবে তুলে ধরতে পারছি না। এতে দেশে বিদেশি পর্যটক বাড়ছে না। অভ্যন্তরীণ পর্যটনে ভর করে উদ্যোক্তারা টিকে আছেন। তবে সেখানেও আছে নানা সীমাবদ্ধতা। অনেক গন্তব্যে নেই পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। ’
ট্যুরিজম ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিডাব) চেয়ারম্যান সৈয়দ হাবিব আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের হোটেলগুলোর এখনো সঠিক স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা যায়নি। অনেক হোটেল টু স্টার মানের না হলেও ফাইভ স্টার হিসেবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি বাড়াতে হবে। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ডিপার্টমেন্টের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ রাশিদুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পর্যটন খাতে প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব আছে। বর্তমানে দেশের ২৩ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন খাতের সঙ্গে যুক্ত। ২০৩০ সাল নাগাদ এই খাতে জনবলের চাহিদা হবে ৪২ লাখ। এর অর্থ, আমাদের দেশের ভেতরে পর্যটন বাড়ছে। এই তথ্য মাথায় রেখে আমাদের পর্যটন খাত নিয়ে কাজ করতে হবে। ’
Posted ১:৫৪ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta